স্টাফ রিপোর্টার: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হক পাচ্ছেন একুশে পদক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি সমাজসেবায় অবদান রাখায় একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
জিয়াউল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চামামুশরীভূজা গ্রামের এক অতিদরিদ্র মুসলিম পরিবারে ১৯৩৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর একুশে পদক পাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষ তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
সৎ মানুষ ও ভালো দই ব্যবসায়ী সর্বোপরি একজন অতি উৎকৃষ্টমানের দই প্রস্তুতকারক হিসেবে তার নাম জেলা থেকে ছাড়িয়ে সারাদেশে। সমাজসেবক হিসেবে তিনি প্রথমত অভাবগ্রস্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে বছর শেষে আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। পরে তিনি স্থানীয় হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাক দেয়া অব্যাহত রাখেন। বর্তমানে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে অনেক ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে আসছেন। জেলা ছাড়া রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও বই দেন তিনি। যেসব ছাত্রছাত্রী দূরদূরান্ত থেকে বই নিতে আসেন তাদের যাতায়াত খরচও দিয়ে থাকেন জিয়াউল হক। ঈদে গরিব দুঃখীর মধ্যে কাপড় বিতরণ এবং প্রচণ্ড শীতে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হক বলেন, আমার বাবা ছিলেন গ্রামের গুয়াল। ষষ্ট শ্রেনিতে উঠে বাবার কাছে বই কিনে চাইলে টাকার অভাবে বই কিনে দিতে পারেনি। পঞ্চম শ্রেণির পর স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এক পর্যায়ে শুরু করি দই বিক্রি।
তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে জেলায় ঘুরে ঘুরে মাথায় করে দই বিক্রি করি। হঠাৎ একদিন মনে হলো আমি যেমন শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছি তেমন অনেক ছেলে মেয়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। তখন আমি অর্থ সম্পদ বিলাশ বহুল গাড়ি বাড়ি না করে শুরু করি বই কিনা। “দই বেচে, বই কিনি” ১৯৬৯ সালে ভোলাহাট উপজেলার মুশরিভূজা গ্রামে জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করি।
তিনি আরো বলেন, এরপর থেকেই শুরু হয় আমার সমাজসেবা। এলাকার স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই প্রদান। গ্রামের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। গরীব দুঃখিদের বাড়ি নির্মান, নলকূপ স্থাপন, দুস্থদের খাদ্য সহয়তা, স্কুল—কলেজে বেতন দেওয়াসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কাজে আর্থিক সাহায্য করে যোচ্ছি। আমার মাধ্যমে শত শত মানুষ উপকৃত হচ্ছে। যত দিন বেঁচে থাকব, মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, আমি কোন দিন ভাবতে পারিনি যে আমাকে একুশে পদক প্রদান করা হবে। পদক পাওয়াতে অতান্ত আনন্দিত। এই পদক আমার সমাজসেবাকে আরও অনুপ্রাণিত করবে। যে কয়দিন বেঁচে আছি আমি কাজ করে যাবো। আমি মারা গেলে আমার ছেলে এই পাঠাগারের দেখভাল করবে।
তার ছেলে মহব্বত আলী বলেন, সমাজসেবা ক্যাটাগরিতে ২০২৪ সালে একুশে পদকে আমার বাবাকে মনোনীত করার জন্য আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি অত্যন্ত খুশি কারণ আমার বাবা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননায় মনোনীত হওয়ায়। আমি আমার বাবার অবর্তমানে এই পাঠাগারের হাল ধরব এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মোজ্জামেল হক চুটু বলেন, তিনি সারা জীবন সমাজের জন্য কাজ করছেন তার স্বীকৃতি হিসেবে দেশ তাঁকে একুশে পদক সম্মাননা দিয়েছে। এর জন্য আমরা গর্বিত, একুশে পদকে জিয়াউল হককে মনোনীত করার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
উল্লেখ্য রহনপুর স্কাউট দল, ভোলাহাট প্রেস ক্লাব, খুলনা পিপি কলেজ, শহিদ সাটু হলে জেলা প্রশাসন (১৯৯৩ সালে), চ্যানেল আই (শহীদ সাটু হলে, ২০০৫), নবাবগঞ্জ নয়াগোলা পাঠাগার, ২০০১ সালে ইটিভি (এক বছর বন্ধের পূর্তিতে) ও ২০০৮ সালে ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। সর্বশেষ তার কাজে মুগ্ধ হয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ ২০০৬ সালে তাকে ‘সাদা মনের মানুষ’ পদকে ভূষিত করে।