স্টাফ রিপোর্টার: আম, ধান ও রেশম এই তিনটি ফসল ছাড়াও কৃষিতে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রন্তিক উপজেলা ভোলাহাট। কৃষিই এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ উপজেলার কৃষক যুগ যুগ ধরে আম চাষ করে আসছে। একমাত্র আম এখানকার কৃষির প্রধান অর্থকারী ফসল। আমের ফলন এবং মূল্যের উপর এখানকার কৃষকের ভাগ্য নির্ভর করে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে ভোলাহাটের আমচাষীদের মুখে হাসি নেই। কারণ কখনও ফলন কম তো কখনো আমের বাজার মূল্যে ধস। আমচাষীরা ২০১৫ সালের পর আর লাভের মুখ দেখেনি। ফলে অনেক আমচাষী আম বাগান কেটে ফেলা শুরম্ন করেছে। ঠিক এমন সময়েই কৃষকের আলোকবর্তিকা হিসেবে হাজির হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তারা কৃষকদের আম বাগানের পতিত জায়গায় মিষ্টিকুমড়া চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে উপজেলার বাগান গুলোতে মিষ্টিকুমড়া চাষের হিড়িক পড়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, “আমবাগানের পতিত জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ ভোলাহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি ইনোভেশন। ২০২০ সাল পর্যন্ত ভোলাহাটে অন্যান্য অঞ্চলের মত স্বাভাবিক সময়ে সামান্য মিষ্টিকুমড়া চাষ হত। কিন্তু আমবাগানে কিছু মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়েছে এবং ফলনও বেশ ভাল হচ্ছে। তখন ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু আমবাগানে মিষ্টিকুমড়ার প্রদর্শনী করা হয়। বাম্পার ফলন এবং ভাল লাভ হওয়ায় ২০২২ সালে প্রায় ২’শ ৫০ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়। এই ফসলের আবাদ আরো বাড়ানোর জন্য ২০২৩, ২০২৪ সালে উপজেলা পরিষদের এডিপি থেকে প্রকল্প নিয়ে প্রায় ৫’শ কৃষককে বীজ সহায়তা দেয়া হয়। প্রায় ১৫০০ কৃষককে প্রশিক্ষণসহ কৃষক সমাবেশ করে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ফলাফল স্বরুপ মিষ্টিকুমড়ার আবাদ পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর ভোলাহাট উপজেলায় ১ হাজার ৬’শ হেক্টর এর উপর মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়েছে।”
মিষ্টিকুমড়া কেন চাষ করছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিষ্টিকুমড়া চাষী মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা আম চাষ করে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। এসময় দেখি আমার প্রতিবেশী আমবাগানে মিষ্টিকুমড়া চাষ করে অনেক লাভ করেছে। কম সময়ে, অল্প পরিচর্যায় বেশি লাভ হচ্ছে তাই দেখে আমি এই ফসলের আবাদ শুরম্ন করেছি।”
মিষ্টিকুমড়া চাষী বেলাল এবছর প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছেন। তিনি বলেন, “আম বাগানের আম সংগ্রহের পর জমি পতিত পড়ে থাকত। কিন্তু এখানে এখন মিষ্টিকুমড়া চাষ হচ্ছে। তাই স্বল্পমূল্যে ৩-৪ মাসের জন্য জমি লিজ নিয়ে আমি মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছি। গতবছর ভাল লাভ হয়েছে। আশা করছি এ বছর ১০০ বিঘা জমি থেকে ৫০ লক্ষ টাকার মিষ্টিকুমড়া বিক্রি করতে পারবো।”
এক বিঘা জমিতে খরচ কত এবং লাভ কত হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষক আজম আলী বলেন, “বিঘা প্রতি ৫-৬ হাজার টাকা খরচ। জমির লিজ ধরলে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ভেদে বিঘাপ্রতি ৮০-৯০ মন ফলন হয়। ১০০০ টাকা মন হলেও বিঘায় ৮০-৯০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “আগে আমরা আম সংগ্রহের পর দীর্ঘদিন বাগানের কোন পরিচর্যা করতামনা। কিন্তু এখন মিষ্টিকুমড়া চাষ করার ফলে জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে, সার দেওয়া হচ্ছে, নিয়মিত বালাইনাশক দেওয়া হচ্ছে। ফলে আম গাছ সারাবছর পরিচর্যার মধ্যেই থাকছে। ফলে গাছের কোন ক্ষতি হচ্ছে না বরং লাভ হচ্ছে।”
কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “অন্য ফসলের মত মিষ্টিকুমড়া বিক্রয়ে কোন ঝুটঝামেলা নাই। অনেক ব্যবসায়ী ফলসহ জমি কিনে নেয়। আবার অনেকে জমিতে এসে মিষ্টিকুমড়া কিনে নিয়ে যায়। ফল বিক্রয় করা নিয়ে কোন টেনশন নাই।”
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ সুলতান আলী জানান, “মিষ্টিকুমড়া মাত্র ৯০ দিনের ফসল। আগষ্ট- সেপ্টেম্বর মাসে লাগানো হয়। শীতের সবজি উঠার আগেই মিষ্টিকুমড়া বিক্রয় করা যায় এবং সারাদেশে এর চাহিদা আছে। খরচ খুব কম এবং প্রয়োজনে ৩-৪ মাস বা তারও বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়। ফলে আমার বিশ্বাস মিষ্টিকুমড়াই কোন লোকসান হবেনা। আমবাগানে আগে মাসকালাই, খেসারি চাষ করা হত কিন্তু এসকল ফসলের তুলনায় মিষ্টিকুমড়ায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক এ ফসলের আবাদ বেশি করছে।”
তিনি জানান, “কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবমতে এ বছর ১৬০০ হেক্টর বা ১২,০০০ বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিঘাপ্রতি ৭৫ মন ফলন ধরলে উৎপাদন হবে ৩৬,৪০০ মে. টন এর উপর। ৮০০ টাকা মন বিক্রি হলে এ বছর প্রায় ৭৩ কোটি টাকার মিষ্টিকুমড়া চাষ থেকে আয় হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। এ সকল বাগানের যদি মাত্র ৩০ ভাগ জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করা যায় তাহলে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মিষ্টিকুমড়া উৎপাদন করা সম্ভব। এ স্বপ্নই দেখাচ্ছে ভোলাহাটের কৃষক ও কৃষি বিভাগ। যে আম গলার কাটা হয়েছে সেখানেই এখন আমের পাশাপাশি মিষ্টিকুমড়া চাষ করে কৃষক হচ্ছে লাভবান। আশার আলো দেখছেন আমচাষী ও বাগান মালিকেরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।